থিংক  ডিফারেন্ট

সমাজকে এগিয়ে নেবার দায়িত্ব আমাদের সবার ।পৃথিবী আরো শান্তির স্থান হয়ে ওঠুক ,মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ,সহানুভূতিসহ সব মানবীয় গুণাবলী বাড়তে থাকুক ।নিত্য নতুন আবিষ্কারের নেশায় মেতে ওঠুক প্রজন্ম ।আর এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে 'থিংক ডিফারেন্ট ' ম্যাগাজিনের পথচলা ।

স্মৃতিপট ফেইসবুক

No comments :


"স্মৃতিপট ফেইসবুক" (কাল্পনিক)

সুশান্ত বিস্বাস




আজ ১৭ই মে ২০৭১ সাল। আমার ৭২ তম জন্মদিন! বসে আছি চেনা শহরের উঁচু দালানের একটি বেলকোনীতে। বাসার সকলেই ব্যাস্ত। হঠাৎ টেবিলের উপর নাতির ল্যাপটপটাতে চোখ গেল। কাজ করতে করতে উঠে হয়তো কোথাও গিয়েছে। ফেইসবুকের নীল দুনিয়াটা চিনতে একটুও ভুল হলো না। ইচ্ছে হলো নিজের আইডিটাতে একটু লগইন করার। শেষবার লগআউট করেছিলাম ৮/১০ বছর আগে। . ল্যাপটপ টা কাছে টেনেই পাসওয়ার্ড টা মনে করে লগইন করলাম। চেনা জগতটাতে অনেক কিছুই বদলে গেছে। অনেক কিছুই নতুন যুক্ত হয়েছে। রিয়েক্ট বাটনেও নতুন আইকন এসেছে। ১০ বছর পর ফেইসবুকে ঢুকে নিজের হোমপেইজ দেখে চোখের কোণায় জল জমলো। যেন হাহাকার করছে সবকিছু। অনেক আগে করা কিছু পেইজের পোস্ট ছাড়া আর কিছুই নেই। . তারপর গেলাম ফ্রেন্ডলিস্টে। যতদূর মনে পড়ে সংখ্যাটা ছিল ৩৩০ বা তার কিছু বেশি। এখনো ৩০০ জন ফ্রেন্ডলিস্টে আছে! তবে বেশিরভাগ চেনা আইডি পড়ে আছে অযত্নে। কিছু আইডির পাশে 'মেমোরিয়াল' লিখা! আমার লিস্টে সবচেয়ে বেশি ফেইসবুকে এক্টিভ ছিল রিয়াজ। আমার কলেজ ফ্রেন্ড। ৫ বছর আগে গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা গেছে। তার আইডিতে করা শেষ পোস্টগুলোতে এখনো মানুষের লাইক পড়ে। ফেরদৌস ছিল শিক্ষক। বেশ জনপ্রিয় ছিল। তার আইডিতেও মেমোরিয়াল শব্দটি যোগ হয়ে গেছে। শুনেছিলাম বছরখানেক আগে মারা গেছে ক্যান্সারে। নন্দিনীর আইডিতাটে এখন আর পোস্ট হয় না। ভার্সিটি লাইফে পোস্ট করা ছবিগুলোতে আমার ছবিগুলোও এখনো পড়ে আছে নীল দুনিয়ায়। স্বামীর সাথে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিল ১০ বছর আগে। এরপর আর কখনো যোগাযোগ হয় নি। আকাশ ছিল খুবই কাছের বন্ধু। ব্যবসায়ে আমাকে বহু সাহায্য করেছিল। তার আইডিতে শেষ পোস্ট হয়েছিল বহুদিন আগে। রাহুল স্যরের আইডিটা দেখে মনের মধ্যে কেমন জানি লাগলো। স্যর আমাকে খুব ভালোভাসত। ছেলে মেয়ে বিদেশে। স্যারের শেষ জীবনটা কেটেছে বৃদ্ধাশ্রমে। সেখানেই মারা যান তিনি। এরকম আরো অনেকেই। প্রতিটি আইডিতেই জড়িয়ে আছে শুধু কিছু স্মৃতি। আর কিছুই নেই। . ফ্রেন্ডরিকুয়েস্টের পেইজে এখনো জমা হয়ে আছে ২৩ টি রিকুয়েস্ট। হঠাৎ দেখলাম ভার্সিটি ফ্রেন্ড শারমিনের আইডিটি। সাথে সাথেই একসেপ্ট করে একটি মেসেজ দিলাম বড় আগ্রহে। কিন্তু শেষবার সে এক্টিভ ছিল ৬ বছর আগে। বুঝতে পারলাম সেও আর কখনো আসবে না এই জগতটাতে। আকাশ, মিরাজ, প্রিয়াঙ্কা, মিনহাজ সবার আইডি গুলোতে ঢুকলাম। কারো কারো আইডিতে চোখে পড়ল নাতি নাতনির ট্যাগ করা সেলফি। তাদের প্রোফাইল পিকচার গুলোর সাথে তাদের বর্তমান চেহারার অনেক অমিল। . ঢুকলাম কলেজের আর ভার্সিটির গ্রুপগুলোতে। এডমিন লিস্টে এখনো আমার নামটা আছে। শেষ পোস্টটাও আমারই করা। এখন শুধুই হাহাকার। চেনা মুখগুলোর হাস্যজ্জ্বল কমেন্ট গুলো পড়ে চোখের জল ধরর রাখতে পারলাম না। একসময় যে পেইজগুলো থেকে নিয়মিত পোস্ট হত সেগুলো এখন পরে আছে অযত্নে। হয়তো তাদের এডমিনরাও আটকে পরেছে আমার মত বার্ধক্যের জালে। কেউ আছে কেউ নেই। কেউ বিদেশ, কেউ চলে গেছে না ফেরার দেশে। একসময় মেসেঞ্জারে ভার্সিটির গ্রুপ গুলোতে মেসেজের খই ফুটতো। শেষবার সেখানে মেসেজ হয়েছিল ১৩ বছর আগে। শেষ মেসেজগুলো পড়তেই স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠল। . বন্ধুবান্ধবের সাথে কাটানো স্মৃতিগুলো জমে আছে এই ফেইসবুকে। নেই শুধু মানুষগুলো। কেউ জীবিত কেউ আজ মৃত। সবাইকেই ঘিরে ধরেছে বার্ধক্য। জীবনের বহু হিসেব ধরে রেখেছে এই ফেইসবুক। প্রতিটি ফ্রেন্ড ফলোয়ারের জন্য জীবনে নষ্ট করেছি কত সময়। অপচয় করেছি ক টাকা। আজ কিছুই নেই। নিজের করা শেষ পোস্টের ককেন্টগুলো পড়ে নিজেই কাঁদছি। বার বার চোখে ভেসে উঠছে স্মৃতিগুলো। . অতঃপর চোখ মুছে শেষবারের মত লগআউট বাটনটাতে ক্লিক করলাম। হয়তো এটাই আমার জীবনের শেষ ফেইসবুকে ঢুকা। বার্ধক্যের ছোঁয়ায় জীবন আজ শেষের পথে। চার দেওয়ালের মাঝে আবদ্ধ হয়ে পড়েছি। চোখ জোড়া বন্ধ করতেই যৌবনের বন্ধুদের সাথে ঘুরাঘুরি, কৌশরের ভার্সিটির বারান্দায় আড্ডা, শৈশবের খেলার মাঠ, সবকিছু ভেসে উঠল। সবই আজ স্মৃতি। অনেকেই চলে গেছে এসবের ওপারে। অনেকে আজো বেঁচে আছে আমার মত নিজের পরিবারটাতে আঁকড়ে ধরে। শেষ সময়টা হয়তো এভাবেই কেটে যাবে। আর কখনো দেখা হবে না বন্ধুদের সাথে। এখন বন্ধু শুধুই পরিবার। জীবনে কত সময় দিয়েছি এই ফেইসবুকে। বাস্তবতার হিসাব কষতাম আমি। অথচ বাস্তবতা আজ আমাকে শেখালো আপন শুধুই পরিবার। বাকী সবাই কোনো না কোনোদিন হারিয়ে যাবে। এটাই জগতের নিয়ম। এভাবেই হাড়িয়ে যায় জীবন। থেকে যায় শুধু স্মৃতি। হারিয়ে যায় সবকিছু। তবুও জীবনের সাক্ষী করে কিছু অতীত ধরে রাখে শুধু ফেইসবুক। 

No comments :

Post a Comment

Thank you

জনপ্রিয় পোষ্ট