থিংক  ডিফারেন্ট

সমাজকে এগিয়ে নেবার দায়িত্ব আমাদের সবার ।পৃথিবী আরো শান্তির স্থান হয়ে ওঠুক ,মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ,সহানুভূতিসহ সব মানবীয় গুণাবলী বাড়তে থাকুক ।নিত্য নতুন আবিষ্কারের নেশায় মেতে ওঠুক প্রজন্ম ।আর এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে 'থিংক ডিফারেন্ট ' ম্যাগাজিনের পথচলা ।

অপরাধী কে ?

No comments :
                               অপরাধী কে ?

"কাল আমার সাজার চার বছর হল। এখনো ছ'বছর বাকি । খুনের আসামি আমি । এই চার বছরে জেলের লোকজনের সাথে না হলেও সেলের ছারপোকা,বেডের উইপোকা আর আরশোলা গুলো বেশ বন্ধু হয়ে গেছে রে ।" বলে একটু কেশে নেয় নির্মল । জেলে এসে বিড়ি খাবার অভ্যেসটা ধরেছে সে । "তারপর?" জিজ্ঞেস করে সামনে বসে থাকা ইমন । একমাস হলো সে জেলে এসেছে । "তার আর পর নেই রে । আগে তোর কথা বল দেখি । দেখে তো ভদ্র মনে হচ্ছে , তা এখানে কি মনে করে এলে ? " বলে একটা আলতো চাপড় মারে ইমনের পিঠে । "দাঁড়াও দাঁড়াও বলছি । আগে চা নিয়ে আসি ।" চা আনতে যায় ইমন । নির্মল বিড়ি ধরায় আর খাতে বসে পা নাচাতে থাকে । একটু পরে ছুটতে ছুটতে ইমন এসে দম নিয়ে বলে " এই নাও চা । উফঃ ওই চায়ের ওখানে আবার ঝামেলা লাগিয়েছে কার্তিক আর কেষ্ট । আমি ফাঁক দিয়ে নিয়ে দৌড়ে এলাম । নাও নাও চা ধরো ।" "হম দে । " বিড়ি টানতে টানতে চা নেয় নির্মল । "আচ্ছা তোমাকে দেখে অন্যদের মতো লাগে না । বেশ শিক্ষিত দেখতে লাগে । এখানে কিভাবে ? " চা খেতে খেতে প্রশ্ন করে ইমন । নির্মল চায়ে চুমুক দিতে গিয়েও না দিয়ে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে খিচিয়ে ওঠে " হ্যাঁ শালা শিক্ষিত । ওই আদর্শ নিয়ে বাঁচতাম বলেই তো নিজের লোককেই..." বলে থেমে যায় নির্মল । "নিজের লোককে কি ?" বল নির্মল দা । একটু ইতস্তত হয়ে পড়ে নির্মল । " তোর এত জেনে কাজ নেই । তুই বহুত ঝানু মাল । নেতা ফেতা ছিলি নাকি রে ? এত ভালো কথা ঘোরাতে পারিস ।" বলে বেশ খানিকটা স্বাভাবিক বোধ করে নির্মল । এবারে ইমন বেশ একটু রেগে গিয়েই বলে" নেতাদের কথা একদম তুলবে না । ওর জন্যই তো আজ এখানে " । "মানে টা কি ? পার্টির গুন্ডা ছিলি নাকি ?হাওয়া পাল্টাতে এখানে পাঠিয়েছে ? " খ্যাক খ্যাক করে হেসে ওঠে নির্মল , যেটা ইমনের উত্তেজনা আরো বাড়িয়ে দেয় । " পার্টির গুন্ডা হলে তো হিল্লে হয়ে যেত । আজকের দিনে বেকারদের কাছে ওটাই সহজলভ্য বুঝলে । জানো চার বছর ধরে গ্রূপ ডি র জন্য পরীক্ষা দিয়েও একটা চাকরি জোটাতে পারলাম না ।" বলে চেয়ারের হাতলে ঘুষি মারে ইমন । "আর একদিন সন্ধেয় দেখি এক নেতা মিটিংয়ে বলছে রাজ্যে নাকি চাকরি অনেক , বেকারত্ব সমস্যা অনেকটা কমে গেছে । রিক্রুটমেন্ট-এ কোনো দুনম্বরী নেই । মাথায় গেল রাগ চড়ে , জুতো খুলে মারলাম তার মুখে । "বলতে বলতেই চায়ের ভাড়টায় শেষ চুমুক দিয়ে মেঝেতে আছাড় মারে । একটু দম নেয় ইমন, জল খেতে খেতে বলে "ব্যস আর যায় কোথায়, পুলিশ সাথে সাথে ধরলো আর তিন মাসের জেল " । এতক্ষন হা হয়ে শুনছিল নির্মল । চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে আরেকটা বিড়ি ধরাতে ধরাতে বললো " হম বুঝলাম । তা এখন থেকে বেরিয়ে কি করবি ? বাড়িতে লোকজন তো আছে নাকি ? খাওয়াতে হবে তো তা... " একরকম অবজ্ঞার সুরে ইমন বলে ওঠে "হু । বাড়ির লোক । তিনকুলে আর কেউ নেই । " "মানে" ? বিস্ময়ের সাথে বলে সে । "আফস্পা আইনের নাম শুনেছ ? " ইমন নিচু স্বরে বলে । "আফস্পা ! " আৎকে ওঠে নির্মল । এবার নির্মল উদাসীন ভাবে বলে চলে " আমার বাড়ি মনিপুরে , মেঘলাপুরায়। মা,আমি আর বাবা ওখানেই থাকতাম । পাঁচ বছর আগে আমি কাজের জন্য কলকাতায় এসেছি। একটা মেসে ছয় জন থাকতাম । টিউশনি পরিয়ে কোনোরকমে চলছিল ।" নির্মলের উসখুশনি বাড়তে লাগলো । হটাৎ একটু যেন সজাগ হয়ে উঠে ইমন বলতে থাকে "একবছরের মাথায় খবর পেলাম গ্রামে মাওবাদী সন্দেহে জওয়ানরা হামলা চালিয়েছে । জানো আমাদের গ্রাম শ্মশান হয়ে গেছিলো । কাউকে মারতে ছাড়েনি ওই শুয়োরের বাচ্চাগুলো । তখনই ঠিক করেছিলাম ফোর্সের হেড কে পেলে মেরে ফেলে দেব " । চিৎকার করে বলে ওঠে ইমন । তারপর নিস্তব্ধতা । নিস্তব্ধতা ভেদ করে একটা কুটিল হাসি হেসে ইমন বলে "তার এক মাস পর খবর পেয়েছিলাম সেই হেড মারা গেছে "বলে আবার হাসলো । " কি জানি নাম, দি-দিগন-..." " দিগন্ত চাকলাদার " । শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলে নির্মল । "হ্যাঁ তাই তো । সেদিন যে কি আনন্দ পেয়েছিলাম না । যে মেরেছিল তার জন্য গর্ব হচ্ছিল । কিন্তু তুমি ওর নাম জানলে কি করে ?" প্রশ্ন করে ইমন । " আমার পুরো নাম নির্মল চাকলাদার । দিগন্ত চাকলাদার আমার বাবা । " সিলিং এর দিকে তাকিয়ে বলে নির্মল । ইমন উঠে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে । নির্মল বিড়ি ধরিয়ে বলতে শুরু করে " যখন ওই ঘটনাটা ঘটে তখন আমি মেঘলাপুরাতেই এক আত্মীয়র বাড়িতে রয়েছি । সেদিন সকাল থেকে খুব চেঁচামেচি চলছিল । বাড়িতে আমি আর আমার কাকা । বাবা হটাৎ ঘরে ঢুকে বলে কাউকে না বেরোতে । বলেই ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যায় । বাবা বেরিয়ে যেতেই কাকা আর্তনাদ করে ওঠে " আফস্পা" । সেদিনই প্রথম কথাটা শুনেছিলাম । তার মানে জানতে চাইলেও কাকা বলেনি । কাকা দোতলায় চলে গেল । আমি একা নিচে বসে রইলাম । " এই বলে ইমনের থেকে বোতল নিয়ে জল খেল সে । " তারপর হটাৎ শুনতে পেলাম গুলির শব্দ । দৌড়ে গেলাম জানলার কাছে । বাইরে তাকিয়ে যা দেখলাম তা দেখে আমি স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম । বাইরে একটা ধোঁয়াটে পরিবেশ হয়েছে । তার মধ্যে দিয়ে দেখলাম কয়েকজন জওয়ান কয়েকজন মেয়ের চুলের মুটি ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে । কয়েকজন বেনয়েট দিয়ে খোঁচাচ্ছে মাঝবয়েসী কয়েকজন কে । মাটি রক্তে ভাসছে । বাচ্চাদের পর্যন্ত লাঠি দিয়ে মারছে । সে এক মর্মান্তিক দৃশ্য । বুঝতে পারছিলাম একেই বলে আফস্পা । অন্যদিকে কয়েকজন পালাচ্ছিল,আমি মনে প্রাণে চাইছিলাম তারা পালাক কিন্তু হটাৎ ধোঁয়াশা মধ্যে এক লোকের এক হাতে বেয়নেট , সে এক বৃদ্ধর পেটে বেয়নেট ঢুকিয়ে হেসে উঠলো, সে কি পৈশাচিক হাসি । ইচ্ছে করছিল গিয়ে মেরে ফেলি । বেশ চেনা লাগছিল তাকে । সে আদেশ করে বাকিদের বললো "ধর ধর । পালাচ্ছে । একটাকেও ছাড়বি না । সবকটাকে শেষ করে ফেল । জঙ্গি কোথাকারে । উদ্বাস্তু সব । মেরে ফেল সবকটাকে । আর শোন দু তিনটে ফ্রেশ মেয়ে আমার জন্য রেখে দিবি । নাহলে সবকটার চাকরি খেয়ে নেব । আমি একটু আসছি । " লোকটা পেছনে ঘুরে আমাদের বাড়ির দিকেই আসছিলো , দেখি সেটা আমার বাবা । নিজের চোখে বিশ্বাস হচ্ছিল না , এই কি সেই আমার বাবা যে আমাকে আদর্শ শিখিয়েছিল, এ তার কি হিংস্র, বর্বর রূপ , বাড়ির দিকেই এগিয়ে আসছে বাবারূপী জন্তুটা । হটাৎ গুলির শব্দ । যারা পালাচ্ছিল তাদের গুল

গুলি করা হয়েছে , আর পালাতে পারলো না তারা । " বলতে বলতে গলা শুকিয়ে এল তার । আবার একটু জল খেয়ে নিয়ে আবার শুরু করলো । " বাড়ির বেল বাজলো । আমি গিয়ে দরজা খুলতেই বাবা ঘরে এসে সোফাতে আরাম করে বসে আমাকে জল আনতে বললো । আমি জল এনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম । বাবা আমাকে দেখতে পায়নি । আমি স্পষ্ট শুনলাম বাবা বিড়বিড় করছে , " আজ বেশ শান্তি লাগছে । আহঃ ! ওই চিৎকার । কি আরাম । " আমি শুনে হতবাক । এ কি ! এত স্পষ্ট জানোয়ার । চেঁচিয়ে উঠলাম "একি বলছো বাবা । এসব কি চিন্তাভাবনা তোমার ?" বাবা আমার দিকে ক্লান্তিভরে তাকিয়ে বললো" ও তুই । আর শোন ওসব ডেইলি ব্যাপার । দে জলটা দে । " " কে তোমায় অধিকার দিয়েছে এই নিরপরাধ মানুষগুলোকে মারার ? " আমার মাথা তখন বো বো করে ঘুরছে । "যাদের নিরপরাধ বলছিস ওরা সব জঙ্গি, দেশের আগাছা । ওদের মারার পুরো অধিকার রয়েছে আমার । একে বলে আফস্পা আইন প্রয়োগ । এসব বুঝবি না ।" তাচ্ছিল্যের সাথে বলে বাবা । আমার মাথা দপ করে জ্বলে ওঠে"কে জঙ্গি ? ওই বাচ্চা ছেলেটাও জঙ্গি, ওই যুবতী মেয়েরাও জঙ্গি, বৃদ্ধরাও জঙ্গি ? তবে তুমি কি ? আর মেয়েদের তোমরা এইভাবে ধর্ষণ করো । " বলতে বলতে সেই টেনে হিচড়ে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যগুলো চোখে ভাসছিল," তুমি তো সরকারি জঙ্গি । আর ওরাও তো মানুষ । তুমিই তো আমায় শিখিয়েছিলে আদর্শের কথা । আর সেই তুমিই আজ..." " থাম তো, পরের ছেলে পরমানন্দ , যত গোল্লায় যায় ততই আনন্দ । ওদের নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই । বাজে না বকে জলটা দিয়ে দূর হ তো । " বাবা বিরক্ত হয়ে বলে । আমি চেঁচিয়ে উঠলাম "ও তার মানে তোমার কোনো অনুশোচনা নেই ? একটুও লজ্জা হচ্ছে না এই কাজের জন্য ? ওই নিরপরাধ মানুষকে মেরে কিসের জওয়ান ? ধিক্কার তোমাদের , তোমাদের রাষ্ট্র যন্ত্রের মুখে । " বাবা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বেশ জোর দিয়ে বললো" না নেই । কোনো অনুশোচনা নেই । এই কাজ আমি আগেও করেছি , আবারও করবো । " বলে একটা দানবিক হাসলো । আমি প্রমাদ গুনলাম । মাথায় একটা চিন্তাই ঘুরছিল এই লোকটা আমার বাবা ছিল কিন্তু তার পাশে এ এক রক্তপিপাসু দানব । বেঁচে থাকলে আরো অনেক গ্রাম উজাড় করবে , " কিরে জলটা দে । আবার বাইরে যেতে হবে ।"এবার আমরা ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল , হিহাতীত জ্ঞানশুন্য হয়ে জোরে চিৎকার করে হাতের গ্লাসটা ছুড়ে মারলাম বাবার দিকে । সেটা গিয়ে লাগলো বাবার কপালে, বাবা মেঝেতে পড়ে গেল, হাতের কাছেই ছিল ফুলদানিটা ,তুলে নিয়ে মারলাম বাবার মাথায় । দুবার মারলাম ।" আহ্হঃ..." চিৎকার করেই এলিয়ে পড়লো সোফাতে । স্পট ডেড । সোফা থেকে রক্ত গড়িয়ে ভেসে যাচ্ছে সাদা মেঝেটা । কাকা নিচে নেমে এল আর আর্তনাদ করে উঠলো " খুননন..." । আমি তৎক্ষণাৎ পালিয়ে গেছিলাম । কিন্তু কতদূরই বা যেতাম । সেই রাতেই ধরা পড়লাম আর তারপর জেলে ।" এই বলে থামলো নির্মল । ইমনের মুখে একটাও কথা বেরোলো না । সে বাকরুদ্ধ । হটাৎ নির্মল এক অট্টহাসি হেসে বললো"আমি তোর বদলা নিয়েছি রে । আমি তোর বদলা নিয়েছি এন্ড আই ডোন্ট রিপেন্ট ফর দ্যাট মার্ডার ।" আবার সেই এক অমানুষিক হাসি । নির্মল আসতে আসতে উঠে তার বেডে গিয়ে শুয়ে পড়ে । নির্মলও চুপ করে বসে থাকে । পরদিনই ইমনের সেল আলাদা হয়ে যায় । মাঝে আর দেখা হয়নি দুজনের । ইমনের ছাড়া পাওয়ার দিন দেখা করেছিল , "ভালো থাকিস আর এমন কাজ করিস যাতে আর এখানে না আসতে হয়" বলেছিলো নির্মল । তারপর বেরিয়ে যাওয়ার সময় বিদায় জানিয়ে ইমন বেরিয়ে গেল । নির্মলের চোখটা তখনও ঝাপসা হয়ে ছিল ।



 লেখক: নিমোর কলম।

No comments :

Post a Comment

Thank you

জনপ্রিয় পোষ্ট